শহীদ নাইমা সুলতানার মা আইনুন্নাহার বেগমের হৃদয় নিংড়ানো আকুতি আর খুনিদের বিচারের দাবিতে উঠে আসে তার যন্ত্রণার কথা। “আমি চাই খুনিদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিচার করা হোক। আমার মেয়েটা ঘরে থেকেও রক্ষা পায়নি। যারা সেদিন গুলি চালিয়ে আমার নিরপরাধ মেয়েটাকে খুন করেছে আমি তাদের বিচার চাই। আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার সরকার যেন এদেশে আর ফিরে না আসে। আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।” —এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন শহীদ নাইমার মা আইনুন্নাহার।
রোববার একান্ত সাক্ষাৎকারে যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, কেমন করে ১৯ জুলাই বিকালে তার ১৬ বছর বয়সী মেয়ে, দশম শ্রেণির ছাত্রী নাইমা সুলতানা ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জীবন হারায়।
ঢাকাসহ সারাদেশে তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছিল, বৈষম্যবিরোধী দাবিতে। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। ঠিক সেই সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের মোবাইল ফোনে বাইরের গুলির শব্দ আর আন্দোলনের কিছু ভিডিও দৃশ্য ধারণ করছিল নাইমা। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে তার মাথার পাশে। এক চিৎকারে ‘মা’ বলে ওঠে নাইমা, এরপরের দৃশ্য যেন কোনো দুঃস্বপ্নের মতো। “আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি নাইমা বারান্দায় পড়ে আছে, মেঝেতে শুধুই রক্ত!” — স্মৃতিচারণ করতে করতে কেঁদে ওঠেন আইনুন্নাহার।
শোকের ভারে ভারাক্রান্ত শহীদ জননী বলেন, “আমার মেয়েটা ঘরের ভেতর থেকেও রক্ষা পেল না। সে তো রাস্তায় ছিল না। বারান্দায় দাঁড়ানোই আমার মেয়ের কাল হলো!” সে দিন বিকালে মেয়ের মৃত্যুর দৃশ্যটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “নাইমা আমাকে বিকালে বলল, মা, পিৎজা বানাব, ফ্রিজে চিকেন আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। তারপর বলল বারান্দা থেকে কাপড় নিয়ে আসছে। আর সে বের হয়েই মৃত্যু বরণ করল।”
তিনি বলেন, “ওর মাথার পাশে এমনভাবে গুলি লাগল যেন কেউ কোপ মেরেছে। ডাক্তাররা তাকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষে দেখি, আমার মেয়ে আর নেই। আমার কলিজার টুকরা নাইমাকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো, তখন বুঝতে পারলাম, আর ফিরবে না সে।”
নাইমার ছোটবেলা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আইনুন্নাহার বলেন, তার মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। “ছোটবেলায় স্কুলে ডাক্তার সেজেছিল সে। সবসময় বলত, বড় হয়ে গরীব মানুষের সেবা করবে। কিন্তু সে আর ডাক্তার হতে পারল না,” — কেঁদে ফেলেন তিনি।
মায়ের মতে, নাইমা বাসায় বসে আন্দোলনের পক্ষে আঁকাআঁকি করত। একটি পোস্টার এঁকে সে ফেসবুকে পোস্টও করেছিল। “ওইদিন দুপুরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় নাইমা মোবাইল ফোনে ওর ম্যাডাম আর বান্ধবীদের কাছে আন্দোলনের খবর জানতে চেয়েছিল,” — বলেন তিনি। পরদিন নিজেও আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল সে।
আন্দোলনে অংশগ্রহণের আগের দিন নাইমা তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “মা, আমিও যদি আন্দোলনে গিয়ে মারা যাই, তাহলে আমার মৃত্যুর বিষয়ে তোমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি কি বলবে?” এই প্রশ্ন শুনে আইনুন্নাহার তার মেয়েকে সান্ত্বনা দেন, কিন্তু নাইমা সেদিন বলেছিল, “আম্মু, আমি যদি মারা যাই, তুমি বলবে আমার মেয়ে শহীদ হয়েছে।” মায়ের কানে এখনো বাজছে তার সেই কথা।
মেয়ের স্মৃতি নিয়ে আইনুন্নাহার বলেন, নাইমার বড় বড় চোখ ছিল, যা এখনো তার মনে পড়ে। নাইমার মৃত্যু তাকে একেবারে শূন্য করে দিয়েছে। “সে শহীদ হওয়ার পর থেকে আমি কিছুই ঠিকমতো করতে পারি না,” — কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন তিনি।
মেয়ে নাইমার দাফন নিয়ে আইনুন্নাহার বলেন, রাতেই তার মামা-চাচারা গ্রাম থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসেন। পরদিন সকালবেলা চাঁদপুরের আমুয়াকান্দি গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা শেষে নাইমাকে দাফন করা হয়।