যুক্তরাজ্যের প্রতিশ্রুতি: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণের পাশে থাকবে

ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক জানিয়েছেন যে, যুক্তরাজ্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমৃদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণকে সমর্থনে অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আজকের সিদ্ধান্তগুলো ভবিষ্যতে দেশের জন্য কীভাবে প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে তিনি আশা প্রকাশ করেন। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি ও তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বুধবার ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ শীর্ষক গবেষণার প্রতিবেদনের আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা উপলক্ষে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সারাহ কুক। এই গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি, চাহিদা ও সম্ভাবনাসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গবেষণায় ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তরুণদের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়ক হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের প্রতিশ্রুতি: অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সহযোগিতা

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সারাহ কুক বলেন, “যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছে এবং তাদের সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সাহসিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে, কারণ আগামী ২০৪০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা পাবে, যা দেশের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ হতে পারে। তবে আজকের সিদ্ধান্তগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করবে এই সম্পদের মূল্যায়ন।”

তরুণদের উন্নয়ন ও চাহিদা

এই অনুষ্ঠানে সারাহ কুক বাংলাদেশের তরুণদের উচ্চাভিলাষী, আশাবাদী ও সামর্থ্যবান হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, তরুণরা শুধু নিজেদের জন্যই নয়, বরং পুরো দেশের উন্নয়নের জন্য ভূমিকা রাখতে চায়। তারা সমাজে নিজেরাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চায় এবং এজন্য মানসম্মত শিক্ষা ও কর্মমুখী দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী।

তিনি বলেন, “তরুণ প্রজন্ম এখন এমন একটি যুগে জন্মগ্রহণ করেছে, যেখানে প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক পরিবর্তন তাদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলছে। তরুণদের জন্য এমন দক্ষতা ও শিক্ষা প্রয়োজন, যা তাদেরকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।”

এই বক্তব্যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে, যা হলো তরুণদের জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার চাহিদা। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের চাহিদার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তরুণরা শুধুমাত্র শিখতে নয়, বরং নিজেদের কাজের মাধ্যমে সমাজে মূল্যবান অবদান রাখতে আগ্রহী।

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ও যুক্তরাজ্যের ভূমিকা

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য তরুণদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন সারাহ কুক। তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং সামনের কাতারে থাকতে হবে।”

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য তরুণ জলবায়ু নেতৃত্বকে সহায়তা করছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য তরুণদের কেবল সচেতন করাই নয়, বরং তাদেরকে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য সরকারের সহযোগিতা দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্বে রূপান্তরিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য আরও সুযোগ তৈরি করতে সহায়ক হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ। তিনি বলেন, “বর্তমানে আমাদের সরকার দেশের তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদাকে বিবেচনা করে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং শ্রমিকদের উন্নতির বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। এছাড়াও দেশের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।”

এতে প্রতীয়মান হয় যে, অন্তর্বর্তী সরকার তরুণ প্রজন্মের চাহিদা ও প্রত্যাশাকে কেন্দ্র করে একটি পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল কার্যক্রম পরিচালনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ গবেষণার মূল তথ্য

ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে করা এই গবেষণাটি বাংলাদেশের তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চাহিদা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়। ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩ হাজার ৮১ জন তরুণের মতামতের ভিত্তিতে এই গবেষণাটি তৈরি করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৬৬ শতাংশ তরুণ অনলাইনে সক্রিয় এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। তরুণদের মধ্যে ছেলেদের ৭৭ শতাংশ এবং মেয়েদের ৫৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা লিঙ্গ বৈষম্যের দিকটিও তুলে ধরে।

এছাড়াও ২৭ শতাংশ তরুণের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই প্রাথমিক সংবাদ উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা আজকের বিশ্বের ডিজিটাল প্রভাবের একটি প্রমাণস্বরূপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের কণ্ঠস্বরকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা।

লিঙ্গ বৈষম্য ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

গবেষণায় উল্লেখ করা হয় যে, দেশের তরুণ প্রজন্মের একাংশ এখনও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৬ শতাংশ তরুণ বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্যের কথা বলেছেন। এছাড়াও ২৭ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ শতাংশ তরুণ মনে করেন যে নারী ও পুরুষ সমান নয়। এবং ঘরের বাইরে নারীদের স্বাধীনতা পাওয়া উচিত বলে মনে করেন না ২৫ শতাংশ তরুণ।

কারিগরি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে আগ্রহ

গবেষণায় দেখা যায়, তরুণদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষা। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ৪৯ শতাংশ তরুণ শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আধুনিক কর্মবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাহীন পাঠ্যক্রমের কথা উল্লেখ করেন।

ফরমাল শিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষতা অর্জনেই তরুণদের আগ্রহ বেশি। দেশের তরুণ প্রজন্ম এখন কাজের উপযুক্ততা বাড়াতে যোগাযোগ দক্ষতা, ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

তরুণদের মধ্যে ইংরেজি ভাষার দক্ষতার চাহিদা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চমানের হলেও, মাত্র ৫ শতাংশ তরুণই ইংরেজিতে দক্ষ বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান সংকট

বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি এই গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে। দেশের তরুণদের ৪২ শতাংশ বেকারত্বের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে অন্যান্য বাধা যেমন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বৈষম্য ও পারিবারিক জীবন ও কাজের ভারসাম্য বজায় রাখা তাদের মধ্যে অন্যতম বাধা হিসেবে উঠে এসেছে।

বেকারত্বের এই সংকটের প্রেক্ষাপটে, ৫৫ শতাংশ তরুণ আন্তর্জাতিক অভিবাসনের জন্য আগ্রহী বলে জানা যায়। পাশাপাশি ৪৪ শতাংশ তরুণ আগামীর ৫ বছরের মধ্যে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে আগ্রহী।

সুপারিশ ও পরামর্শ

গবেষণায় উঠে আসা সমস্যাগুলোর সমাধানে কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এই সুপারিশগুলোতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া, কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ এবং ইংরেজি ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত বলে বলা হয়েছে।

নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত নীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের জন্য আরও সুযোগ তৈরি করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে তরুণদের সচেতনতা বাড়ানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

গবেষণায় প্রতীয়মান যে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম উচ্চাভিলাষী, চ্যালেঞ্জ গ্রহণে দৃঢ় এবং সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে আগ্রহী। তবে, তারা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং শিক্ষাগত ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছে।

Author

  • Md Shohanuzzaman

    Md. Shohanuzzaman Author & Developer at News Orchid 24With a passion for delivering accurate news and insights, Md. Shohanuzzaman is the driving force behind News Orchid 24. As both an author and developer, Shohanuzzaman is dedicated to creating a user-friendly, informative platform where readers can stay updated on key events and trends. His expertise combines content creation with technical proficiency, ensuring News Orchid 24 maintains its commitment to quality and accessibility.

    View all posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *